‘কৃষি সংস্কার কমিশন’ গঠনের জন্য ‘বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলন’ এর পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা

লালমনিরহাট প্রতিনিধি : বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলন লালমনিরহাট জেলা শাখা জেলাপ্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিকট লিখিত ভাবে প্রস্তাবনা প্রেরণ করেছেন।

রবিবার দুপুরে লালমনিরহাট জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ে লিখিত প্রস্তাবনা পেশা করার পরে এক সংক্ষিপ্ত পথ সভা অনুষ্ঠিত হয়ে। উপস্থি ছিলেন
বাংলাদেশ ভুমিহীন আন্দোলন কেন্দ্রীর সাধারণ সম্পাদক শেখ নাসির উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছামিউল আলম রাসু। লালমনিরহাট জেলা কমিটির আহবায়ক মোঃ আব্দুল হামিদ ,যুগ্ম আহবায়ক মোঃ আশরাফুল আলম প্রমুখ।

বক্তারা বলেন বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ও কৃষিভিত্তিক দেশ। অধুনা শিল্প, সেবা, জনশক্তি রপ্তানীসহ নানাবিধ খাত এগিয়ে আসায় কৃষির ভূমিকা কিছুটা কমে আসলেও সবচাইতে প্রাথমিক এবং মৌলিক খাত হিসাবে কৃষির অবদান এককভাবে এখনো সবচেয়ে বেশি।

আমাদের কৃষি চলছে দৃশ্যত পরিকল্পনাহীন পরিকল্পনা দিয়ে। কৃষি ব্যবহৃত হচ্ছে লাভজনক কর্মে যুক্ত হওয়ার সুযোগবঞ্চিতদের শ্রম এবং লাভজনক খাতে বিনিয়োগের সুযোগবঞ্চিতদের বিনিয়োগকৃত পুজি আত্মসাৎ করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে। এই আত্মসাৎকরনের মূল হাতিয়ার হলো বাজার ব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক মাফিয়াদের জবাবাদিহিীন একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন বা কর্তৃত্ব। কৃষিক্ষেত্রে আত্মসাৎকারীদের বিশেষ সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে গ্রাম জীবনের সংস্কৃতি। কৃষকের কাছে কৃষি এখনো কেবলমাত্র মুনাফাক্ষেত্র নয়, জীবন প্রণালীও। আর কৃষক কেবলমাত্র জমির মালীক নয়, গ্রামে বসবাসকারী বা গ্রাম সংলগ্ন ভূমিহীন, অপ্রতিষ্ঠানিক খাতের সকল ধরনের শ্রমিকেরাও সাংস্কৃতিকভাবে কৃষক।

আমাদের নানাবিধ ফসলের পাশাপশি মাছ, মাংস, দুগ্ধ, চা, চামড়া, পাটজাত পণ্যসহ নানাবিধ কৃষি উপকরনের হিসাব করলে এখন পর্যন্ত কৃষিই এখানকার একক বৃহত্তম মৌলিক জাতীয় আয় ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। কিন্তু মাফিয়া সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে এখানকার ভূমির স্বাস্থ্য, খাদ্যচক্র, নদনদী-বিল-বাউর, প্রাকৃতিক মৎস্যক্ষেত্র, ভূগর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থিত পানি, জীব বৈচিত্র, বন-বাদার সবই ধ্বংসের পথে। কৃষির সাথে জড়িত কৃষকদের অর্থনৈতিক এবং শারিরীক অবস্থা ভয়াবহ, এর মধ্যে সবচাইতে ভয়াবহ হলো ভূমিহীন নারী-পুরুষ কৃষকদের অবস্থা।

বাংলাদেশের এবারের গণঅভ্যুত্থান, বৈষম্যমুক্তির যে দাবীকে সামনে এনেছে, তার প্রতি ন্যূনতম সুবিচার করতে হলে সর্বাগ্রে এখানে এই ভূমিহীন নারী-পুরুষদের জন্য বর্তমান বাস্তবতায় কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করা সম্ভব তা নিরূপণ করা সর্বাধিক অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে কৃষি, কৃষক ও ভূমিহীনরা কোন প্রকার আলোচনাতেই নাই অথচ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, স্বার্বভৌম, মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও টিকিয়ে রাখার প্রথম শর্ত হলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা।

এই বাস্ততাকে বিবেচনায় রেখে রাষ্ট্র সংস্কারের অপরাপর ক্ষেত্রের পাশাপাশি ‘কৃষি সংস্কার কমিশন’ গঠন করার জন্য জোড় দাবী জানাচ্ছি। ইতিপুর্বে আমরা সারাদেশের ভূমিহীন এবং বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে তাদের মতামতের ভিত্তিতে যেসব দাবী-দাওয়া তুলে ধরেছিলাম তা আবারও এর সাথে যুক্ত করে দিচ্ছি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়নে ভূমিহীন কৃষকদের প্রস্তাবনা:
১) কৃষি, কৃষক এবং ভূমিহীনদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভূমিহীন প্রতিনিধিদের অর্ন্তভূক্ত করে একটি আলাদা কমিশন গঠন করতে হবে।
২) ভূমি সংস্কার, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং প্রকৃতিবান্ধব অধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রচলনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।
৩) খাসজমি অর্পিত জমি, সিলিং উদবৃত্ত জমি, বিভিন্ন সংস্থার পরিত্যাক্ত জমি যথাযথভাবে চিহ্নিত করে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্টনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) খাল-বিল-জলাশয় অগ্রধিকার ভিত্তিতে প্রকৃত ভূমিহীন জেলে-কৃষকদের মধ্যে বরাদ্দ দিতে হবে এবং বরাদ্দ কমিটিতে ভূমিহীনদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৫) হাউজিং ও রিয়েল এষ্টেট ব্যবসার নামে দরিদ্র এবং নিরীহ জমির মালিকদের জমি দখল, নামমাত্র নামে বিক্রয়ে বাধ্য করেছে এমন জবর দখলকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এইসব ব্যবসার নামে সাধারন মানুষদের উচ্ছেদ করে গৃহহারা, জমিহারা না করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬) উন্নয়নের নামে আইন অমান্য করে তিন ফসলী জমি অধিগ্রহন বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে অধিগ্রহনকৃত এমন প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
৭) সংবিধানে উল্লেখিত ‘স্থানীয় শাসন’ পরিবর্তন করে প্রকৃত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনে বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ বাতিল করতে হবে।
৮) সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ সকল কমিশনে ভূমিহীন কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে।
৯) (ক) জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে ‘সংবিধান সংস্কার সভা’র নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানের গণক্ষমতাতান্ত্রিক সংস্কার করতে হবে।
(খ) ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র কৃষকদের সরকারী খরচে চিকিৎসা ও তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
(গ) ভূমিহীনের ছেলেমেয়েদের যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঘ) ৬০ বছরের উর্ধে ভূমিহীনদের বয়স্কভাতা নুন্যতম ০৫ (পাঁচ) হাজার টাকা দিতে হবে।
(ঙ) প্রত্যেক ভূমিহীনদের পারিবারিক সদস্য সংখ্যানুপাতে রেশন কার্ড/টিসিবির খাদ্য সামগ্রী নির্ধারিত মূল্যে প্রদান করতে হবে।

Share