এস. এম. সুলতান: বাংলাদেশের চিত্রকলার কবি
সপ্তর্ষি: এস. এম. সুলতান (১৯২৩-১৯৯৪) ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী চিত্রশিল্পী, যিনি গ্রামীণ জীবনের শক্তিশালী প্রতিচ্ছবি ও প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র শিল্পধারা সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান হলেও শিল্প জগতে এস. এম. সুলতান নামেই পরিচিত। সুলতান নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একজন কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও তিনি চিত্রকলার প্রতি অদম্য আগ্রহ দেখান এবং তাঁর শিল্পীজীবন শুরু হয় খুব ছোটবেলাতেই।
শৈশব থেকেই সুলতানের মধ্যে শিল্পের প্রতি আকর্ষণ গড়ে ওঠে, এবং তিনি স্থানীয় কারিগরদের সঙ্গে মিশে তাঁদের কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নিতেন। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, তবে সেখানে প্রথাগত শিল্পশিক্ষা তাঁকে তেমন টানেনি। শিল্পের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র এবং প্রথাবিরোধী। কলকাতা থেকে বেরিয়ে তিনি নিজস্বভাবে শিল্পচর্চা শুরু করেন এবং ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে তাঁর প্রথম দিকের কিছু কাজ বেশ সাড়া ফেলে।
সুলতানের চিত্রকর্মে বাঙালি গ্রামীণ মানুষের জীবন ও সংগ্রাম প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসে। তাঁর ছবি বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করে মানুষের শরীরের গঠনশৈলী এবং আকারের জন্য। তিনি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষদের মূর্তিতে বিশাল পেশীবহুল অবয়ব দিতেন, যা প্রতীকীভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তির পরিচয় বহন করত। এই আকার ও বলিষ্ঠতা সুলতানের শিল্পকর্মকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। সুলতানের চিত্রকর্মে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। তিনি এমন এক সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেন যখন আধুনিকতা গ্রামীণ জীবনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল, আর সুলতান সেই গ্রামীণ জগতের শক্তি ও সংগ্রামকে রূপ দিয়েছিলেন তাঁর ক্যানভাসে।
১৯৫০-এর দশকে সুলতান ইউরোপে ভ্রমণ করেন, যেখানে তাঁর শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেয়। ১৯৫০ সালে লন্ডনের একটি প্রদর্শনীতে তাঁর কাজ বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোর শিল্পকর্মের সাথে একত্রে প্রদর্শিত হয়। এই সম্মিলিত প্রদর্শনীতে সুলতানের অনন্য শিল্পশৈলী বিশেষ নজর কাড়ে। পিকাসোর মতো একজন বিশাল প্রভাবশালী শিল্পীর সাথে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সুলতানের জন্য বড় ধরনের স্বীকৃতি ছিল এবং আন্তর্জাতিক শিল্পমহলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে তিনি ইউরোপের খ্যাতি ও আর্থিক সুবিধা ত্যাগ করে নড়াইলে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি গ্রামের মানুষদের নিয়ে শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখেন।
এস. এম. সুলতান ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও সৃজনশীলতা তাঁকে অনন্য এক স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।