কোহেনের সুরে জীবন: প্রেম ও অস্তিত্বের অনুসন্ধান
সপ্তর্ষি : লিওনার্ড কোহেন ছিলেন একজন কানাডীয় কবি, গীতিকার, ও সংগীতশিল্পী, যিনি তার গভীর ভাষা, মরমী গান, এবং তীব্র বোধশক্তি দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। ১৯৩৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিয়ালে জন্মগ্রহণ করেন কোহেন। প্রথমে তিনি কবি হিসেবে তার জীবন শুরু করেছিলেন, এবং তার প্রথম কবিতার বই Let Us Compare Mythologies প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। তবে পরে তিনি গীতিকার ও গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান।
কোহেনের সংগীতজীবন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে, যখন তার প্রথম অ্যালবাম Songs of Leonard Cohen প্রকাশিত হয়। তার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল গভীর, ব্যক্তিগত অনুভূতি ও দর্শন। প্রাথমিকভাবে তার গানগুলো বেশি জনপ্রিয় না হলেও ধীরে ধীরে তার গানের লিরিক্স এবং সুর তাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে। তার গানের মধ্যে প্রেম, একাকীত্ব, ধর্ম, রাজনীতি এবং অস্তিত্বের প্রশ্নগুলো গভীরভাবে তুলে ধরা হয়।
লিওনার্ড কোহেনের অনেক গান আজও বিশ্বজুড়ে শ্রোতাদের মনে গভীর ছাপ রেখে গেছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে:
“Hallelujah”: কোহেনের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে তার Various Positions অ্যালবামে। “Hallelujah” মূলত একটি ধর্মীয় শব্দ হলেও কোহেনের এই গানে তা ভালোবাসা, বিশ্বাস ও জীবনের অর্থ নিয়ে গভীর ভাবনার প্রকাশ ঘটায়। গানটি নানা সময়ে বিভিন্ন শিল্পী দ্বারা কাভার করা হয়েছে এবং এটি এক ধ্রুপদী সংগীত হিসেবে স্থান পেয়েছে।
“Suzanne”: লিওনার্ড কোহেনের প্রথম অ্যালবাম Songs of Leonard Cohen (১৯৬৭)-এর একটি অন্যতম জনপ্রিয় গান। এটি কোহেনের কবিতার উপর ভিত্তি করে লেখা, মূলত সুজান ভারডালের সাথে তার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তৈরি। সুজান ছিলেন কোহেনের বন্ধু, যিনি কোহেনকে মন্ট্রিয়ালের সেন্ট লরেন্স নদীর ধারে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন, এবং তারা একসাথে সময় কাটাতেন।
গানটি প্রেম, আধ্যাত্মিকতা এবং মানব সম্পর্কের গভীরতা তুলে ধরে। সুজানকে নিয়ে গানের প্রতীকী ব্যাখ্যা প্রেমের বিভিন্ন স্তর এবং আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ করে। কোহেন একদিকে তার প্রেমের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন, আবার অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতার সাথে তার সংযোগের কথা বলেন।
“Suzanne” গভীর, সংবেদনশীল এবং ধ্রুপদী প্রেমের গানের এক অনন্য উদাহরণ, যা আজও শ্রোতাদের মনকে ছুঁয়ে যায়।
“Dance Me to the End of Love”: লিওনার্ড কোহেনের ১৯৮৪ সালের Various Positions অ্যালবামের একটি বিখ্যাত গান। যদিও গানটি প্রেম ও রোমান্টিকতার সুরে গাওয়া, এর পেছনে গভীর ও মর্মান্তিক ইতিহাস রয়েছে। কোহেন হলোকাস্টের সময় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ইহুদি সংগীতশিল্পীদের দ্বারা বাজানো সংগীত থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, যাদের মৃত্যুর মুখে সংগীত পরিবেশন করতে বাধ্য করা হতো। গানের কথা জীবন ও মৃত্যুর মেলবন্ধনের প্রতীক, যেখানে প্রেমের ভঙ্গুরতা এবং জীবনের চূড়ান্ত যাত্রার দিকে এক ধরনের ইঙ্গিত রয়েছে।
“Bird on the Wire”: এই গানটি কোহেনের কাব্যিক দক্ষতার আরেকটি উদাহরণ। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এই গানটি স্বাধীনতার জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং বাধা-বিপত্তির প্রতীকী প্রকাশ। কোহেন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, এ গানের মূল ধারণা আসে গ্রিসে থাকার সময়, যখন তিনি একটি তারের উপর বসা পাখিকে দেখেছিলেন। পাখিটি স্বাধীনতা এবং মুক্তির প্রতীক হিসেবে তার মনে গেঁথে যায়। গানের লিরিক্সে সেই স্বাধীনতা এবং জীবনের সীমাবদ্ধতা, ভুল এবং ক্ষমার অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে।
“Famous Blue Raincoat”: লিওনার্ড কোহেনের অন্যতম গভীর এবং রহস্যময় গান, যা ১৯৭১ সালে তার Songs of Love and Hate অ্যালবামে প্রকাশিত হয়। গানটি একটি চিঠি আকারে লেখা, যেখানে একজন ব্যক্তি তার বন্ধুকে, একটি পুরনো সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
গানের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেমের জটিলতা এবং ক্ষমার অনুভূতি। গানের মূল চরিত্রটি তার স্ত্রী এবং বন্ধুর মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্কের কারণে হতাশা ও বিষণ্ণতা প্রকাশ করে, তবে শেষ পর্যন্ত ক্ষমার দিকে এগিয়ে যায়। গানটি তার জটিল লিরিক্সের কারণে শ্রোতাদের কাছে নানা ধরনের ব্যাখ্যার সুযোগ দেয়। গানটির মূল ভাব প্রেম, প্রতারণা, এবং একাকীত্বের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে, যা কোহেনের অন্যান্য কাজের মতোই কবিতার মতো গভীর।
ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি বৌদ্ধধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং কিছু সময় একটি বৌদ্ধ মঠেও কাটিয়েছিলেন। তার জীবন ও চিন্তাভাবনা তার গান ও লেখার মধ্যে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
কোহেন ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর মারা যান, তবে তার গান ও লেখা আজও সারা বিশ্বে তার ভক্তদের মধ্যে জীবিত রয়েছে।