বন্ধ হোক ইউপি’তে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ বানিজ্য
মনজুরুল ইসলাম মেঘ : মাঠ পর্যায়ের রাষ্ট্র কাঠামো পরিচালনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ কে নিরপেক্ষ, সচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠা করা যেমন জরুরী তেমনি রাষ্ট্রের উচিৎ জনগনকে সচেতন করে যোগ্য ব্যক্তিদের রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচিত করতে জনগনকে উৎসাহ দেওয়া। বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা সচ্ছ না, আবার বাংলাদেশের ভোটাররাও সচেতন নয়। যার কারণে বাংলাদেশে প্রায়ই অসৎ, কালোটাকার মালিকরা নির্বাচিত হয়ে আসে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বাংলাদেশে খুব কম ই যোগ্য লোক নির্বাচিত হবার একাডেমিক তথ্য আছে। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরে মন্ত্রীপরিষদ বাতিল করে সংসদ বিলুপ্ত করা হয়, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা নির্বাচিতদের পদ বিলুপ্ত করা হলেও, স্থানীয় সরকারের মাঠ পর্যায় ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়নি অর্নন্তবর্তী সরকার।
বিগত এই ৪ মাসে ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রীক দূর্নীতি, অনিয়ম অতীতের যে কোন সময়কে হার মানিয়েছে। আগে আওয়ামী লীগ সরকার ও আওয়ামী লীগ দলীয় নেতৃবৃন্দ লুটপাট করতো। এখন ভয় দেখিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে দুর্নীতি করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদের নিয়োগ বানিজ্যে। কোন কোন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ পেতে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। এই টাকাও আবার খরচ করছে সাময়িক বরখাস্তকৃত চেয়ারম্যান।
সারাদেশের প্রায় সব ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের নেতারা। জুলাই বিপ্লবের পরে গ্রেফতার এড়াতে আত্নগোপনে আছে প্রায় সব নির্বাচিত চেয়ারম্যান। পলাতকরা নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে এবং আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে এই আশায় নিজেদের পছন্দ মত প্যানেল চেয়ারম্যানকে (তিনিও আওয়ামী লীগের) অথবা পলাতক চেয়ারম্যানের মনোনিত কোন ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এই দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে অধিকাংশ আওয়ামী লীগের নিয়োগ প্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা- ইউএনও এবং উপজেলা প্রশাসন। কোথাও কোথাও এই নিয়োগ বানিজ্য কোটি টাকার বিনিময়ে হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
দেশের অনেক জায়গাতেই এই বিষয়ে তীব্র ক্ষোপ জানিয়েছেন নির্বাচিত সাধারন ইউপি সদস্যরা। উপজেলা প্রশাসন ইউপি সদস্যদের কোন মতামত না নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে আইন অমান্য করেছেন বলেও অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। নিয়ম অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে হলে সকল সদস্যদের গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু সেটা করা হচ্ছেনা সারাদেশের কোন ইউনিয়ন পরিষদেই।
প্রশাসনে অনিয়ম ও ঘুষ বানিজ্যের মাধ্যমে সারাদেশে ইউপি “প্যানেল চেয়ারম্যান” নামে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানানোর যে ধান্দাপাতি চলতেছে, তা বন্ধ করতে হবে। দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে এই দেশের জনগন অন্তবর্তী সরকারকে সহযোগিতা করবেনা। বাঘেরহাট, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায় প্রকাশ্যে ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান নিয়োগের একাধিক প্রতিবাদ হয়েছে। বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক এই ধরনের দুর্নীতি নিয়ে গত ২১ আগস্ট জাতীয় দৈনিক “সবুজ বাংলাদেশ” পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। যেটির সত্যতা পাওয়া গেলেও প্রশাসন অদৃশ্য কারণে এখনো নিরব, গ্রহণ করা হয়নি কোন পদক্ষেপ।
উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রানালয় থেকে ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান নিয়োগ করার কোন আইনত বৈধতা নেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে। কেনো না বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পতন হয়েছে, অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হয়েছে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তর, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। ইউপি পরিষদও ভেঙ্গে দিতে হবে, অথবা স্থানীয় সরকারের অন্যান্য পর্যায়েও পদ ফিরে দিতে হবে। কোথাও সংস্কার হবে আবার কোথাও নিয়োগ দুর্নীতি হবে, একই দেশে দুই নীতি হতে পারেনা।
অবিলম্বে সরাদেশের চেয়ারম্যান নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করে নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানরা নিজেদের শক্তি বজায় রাখতে, মোটা টাকার মাধ্যমে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়ে সুবিধামত সময়ে প্রতি-বিপ্লবের অপচেষ্টা করতেছে, সেই কারণেই নিজেদের পছন্দমত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ করিয়ে মাঠের শক্তি ধরে রাখার চেষ্টা করতেছে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা। ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যানরা যদি আওয়ামী লীগের ইন্ধোনে আন্দোলনের নামে কোন অপেচেষ্টা করার ষড়যন্ত্র করে তাতে দেশের শান্তি বিঘ্ন হতে পারে।
অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান নিয়োগের পরিনতি ভয়াবহ খারাপের দিকে যাচ্ছে। সংঘর্ষ, প্রতিবাদ, মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন, সেই সকল ইউনিয় পরিষদে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইউপি সদস্যদের একটি সমর্থন পেতে ৫/১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জনমুখে। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠলে খুব দ্রুতই রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে পড়বে।
অনেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান নিয়োগ বানিজ্য করে কোটি কোটি টাকা তুলে নিচ্ছেন। তাদের নিজেদের এবং পুষ্যদের সম্পদের হিসেবে নিতে হবে এবং ব্যাংক একাউন্টি বাজেয়াপ্ত করে তদ্বন্ত করতে হবে। দেশের সকল উপজেলায় ইউএনও কে অতিদ্রুত বদলি করে মাঠপ্রশাসনে অনিয়ম বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে অন্তবর্তী সরকারকে। তা না হলে যে কোন সময় মাঠ পর্যায়ে একটি বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং সেই ক্ষতির দায় অন্তবর্তী সরকার কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবেনা।