সংস্কারের নামে চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালায় ভাউতাবাজি

মনজুরুল ইসলাম মেঘ : চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা ২০২৫ এ এমন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যাতে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে গভীর ভাবে। সংস্কারের নামে যে বিষয়গুলি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে:

(১) নতুন নীতিমালা থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রের কথা আগের নীতিমালায় উল্লেখ থাকলেও চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা ২০২৫ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, যুক্ত করা হয়নি জুলাই বিপ্লবের চেতনা বিষয়ক কোন শব্দ। নীতিমালায় লেখা হয়েছে “এই অঞ্চল” যা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, নিজস্ব ভৌগলিক সীমা আছে, নীতিমালায় “এই অঞ্চল” শব্দ ব্যবহার করে বাংলাদেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব কে হেয় করা হয়েছে । এটি সংশোধন না করলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়বে।

(২) গল্পের জন্য ২ (দুই) লাখ, চিত্রনাট্যের জন্য ৩ (তিন) লাখ টাকা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। আগে এটি ছিলো ৫০ হাজার করে মোট এক লাখ। সেটি এখন ৫ লাখ টাকা করায় হোস্ট রাইটার বেড়ে যাবে। প্রভাবশালী সরকারী কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের নামে গল্প ও চিত্রনাট্য লেখার জন্য হোস্ট রাইটার রাখবে। যার কারণে দুর্নীতি বেড়ে যাবে। অনুদানের জন্য ৭৫ লাখ টাকা বাজেট দিবে সরকার, সুতরাং প্রযোজক ই গল্প ও চিত্রনাট্যকার কে সম্মানি দিবেন, সরকারকে আলাদা ভাবে ৫ লাখ টাকা প্রোণদনা দেয়ার প্রয়োজন নেই। সরকার আগের মতই ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার করে মোট ১ (এক) লাখ টাকার প্রণোদনা বহাল রাখতে পারেন।

(৩) পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য করা হয়েছে ৭০ মিনিট, যা চলচ্চিত্র ধ্বংস করে দিবে। নাটক বা টেলিফিল্ম তৈরী করে প্রভাবশালীরা অনুদান দখল করবে। ভালো সিনেমা নির্মাণ হবেনা। ৭০ মিনিটের সিনেমা দর্শক টিকেট কেটে দেখবে না। দর্শক সরকারী অর্থে নির্মিত সিনেমার দেখা থেকে বঞ্চিত হবে।

(৪) চলচ্চিত্র অনুদানের বাছায় কমিটিতে বাংলাদেশ ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট এর প্রধান কে রাখা হয়েছে,  এটি অপ্রাসঙ্গিক। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি হবার সম্ভাবনা থাকে, কারণ তিনি তার প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্টদের অগ্রাধিকার দিবেন। নীতিমালায় এমন কিছু করা যাবেনা যা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিবে অনুমান হয়। অনুদান কমিটি ও বাছায় কমিটিতে নিরপেক্ষ লোক রাখতে হবে, এমন বিধান করতে হবে।

(৫) নতুন অনুদান নীতিমালা  ২০২৫ এ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সময় দেয়া হয়েছে ১৮ মাস, আগের নীতিমালায় ছিলো ৯ মাস। তবুও বছরের পর বছর সময় লেগেছে, আর এখন ১৮ মাস বিধান করা হলে সরকারী অর্থ দুর্নীতি করার সুযোগ বাড়বে। নির্মাণের প্রয়োজনে যদি কোন সিনেমার সময় বেশি প্রয়োজন হয় এবং সেটি যুক্তিসঙ্গত কারণ হয় তাহলে তো সময় বৃদ্ধি করার সুযোগ আছে, তারপরও কেনো ১৮ মাস সময় দিতে হবে? এক অর্থ বছরের সিনেমা ঠিক কি কারনে অন্য অর্থ বছরে নির্মাণ হবে?

(৬) অনুদানের সিনেমা নির্মাণের পরে ৫ টি সিনেমা হলে মুক্তি দেয়ার কথা বলা হয়েছে অথবা ১০ টি জেলায় প্রদর্শনের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। এটি হলে সিনেমা ধ্বংস হয়ে যাবে। গড়পতর্তা নামকা ওয়াস্তে অনুদানের টাকা লুটেপুটে খেয়ে ভিডিও নির্মাণ করে ১০ জেলায় প্রদর্শন করুক আর না করুক। প্রদর্শিত হয়েছে বলে বিবেচিত করার সুযোগ থাকবে। যার কারণে অনিয়ম ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে। অনুদানের সিনেমা মান সম্মত হতে হবে এবং কমপক্ষে ১৫ টি সিনেমা হলে মুক্তির বাধ্য বাধ্যকতা রাখতে হবে।

(৭) অনুদানের সিনেমা মুক্তি দিতে সাধারন প্রযোজকের থেকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এই বিধান রাখা হয়েছে নীতিমালায়। যা চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস করে দিবে। একজন প্রযোজক অর্থ লগ্নি করে অনুদানের চলচ্চিত্রের রোষাণলে পড়ে দেউলিয়া হতে পারে। অনুদানের সিনেমা প্রদর্শনের জন্য সরকারী কর রেয়ত দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে সংস্কার করা নীতিমালা ২০২৫ এ, যা সিনেমা হল ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করার ষড়যন্ত্র। রেয়দ দেওয়ার বিধান করলে সব ধরনের সিনেমাতে রেয়ত দিতে হবে।

(৮) অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী পরিবর্তনের বিধান রাখা হয়েছে। যা আগের কোন নীতিমালায় ছিলোনা। একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার বিশ্লেষন করে অনুদান দেয়া হয়। প্রস্তাবিত শিল্পীদের উপর নির্ভর করে গল্প তৈরী হয়। এখন অনুদান পাওয়ার পরে প্রযোজকের প্রতি হিংসার কারনে পরিচালক পরিবর্তন করা হলো, শিল্পী পরিবর্তন করা হলো, তাহলে তো ঐ অনুদানের সিনেমা সঠিক ভাবে হবেনা। এটা ক্রিয়েটিভ কাজ। একজন পরিচালক সিনেমাটির বাস্তবায়ন করেন। সিনেমা তো রাস্তা, বিল্ডিং নয় যে টিকাদার দিয়ে নির্মাণ করাবেন।

যদি তাই করতে হয়, তাহলে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে টেন্ডার আহ্বান করে গল্প দেন, কে কম টাকায় সিনেমা বানাবে প্রপোজাল দেক। যে ভাবে রাস্তা ঘাটের টেন্ডার হয়।

সিনেমা ই যদি নির্মাণ করতে হয় সরকারী অর্থে তাহলে কোন ভাবেই পরিচালক পরিবর্তন করা যাবেনা। বিশেষ কারণ উঠলে অনুদান বাতিল করতে হবে। আর শিল্পী পরিবর্তনও করা যাবেনা। শিল্পী পরিবর্তনের সুযোগ দিলে প্রযোজক পরিচালকের ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারনে কোন শিল্পীর ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অনুদানে প্রস্তাবিত তালিকায় কোন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর নাম দেয়া থাকলো। অনুদান পাওয়ার পরে সেই চরিত্র সাধারণ কোন শিল্পী করলে প্রস্তাবিত ঐ শিল্পীর উপর চাপ পড়বে, তিনি মানুষিক চাপে পড়ে ক্যারিয়ার ধ্বংস হতে পারে।

এই ব্যাপারে নীতিমালায় উল্লেখ করতে হবে, প্রস্তাবিত তালিকা অনুযায়ী অনুদানের সিনেমা নির্মাণের করতে হবে। অথবা শুধু প্রযোজক চিত্রনাট্য জমা দিবেন, অনুদান পাওয়ার পরে তিনি পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়োগ দিবেন। এই দুটির যে কোন একটি বেছে নিতে হবে অনুদান নীতিমালায়।

কোন পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের ইমেজ বিক্রির মতন বেআইনী বিষয় চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালায় থাকতে পারেনা।

(৯) চলচ্চিত্র অনুদানের বাছাই ও তত্বাবধান কমিটি যে কয়টা প্রস্তাবনা সিলেক্ট করে দিবে এর মধ্য থেকেই অনুদান দিতে হবে এই বিধান সাংবিধানিক অধিকার হরণ করার সামিল। চলচ্চিত্র অনুদান বাছাই ও তত্বাবধান কমিটির সিদ্ধান্ত সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। সেহেতু চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি চাইলে বাতিল হওয়া প্রস্তাবনা রিভিউ করতে পারবে অথবা চলচ্চিত্র অনুদান প্রস্তাবনা আপিল কমিটির বিধান রাখতে হবে নীতিমালায়। বাছাই ও তত্বাবধান কমিটিকে সর্ব ক্ষমতা দেয়া হলে দুর্নীতি ও অনিয়ম বৃদ্ধি পাবে।

(১০) চলচ্চিত্র অনুদানের বাছাই ও তত্বাবধান কমিটির ৪ জন সদস্যকে অনুদান কমিটিতে রাখা হয়েছে। যা অযৌক্তি। চলচ্চিত্র অনুদান বাছাই ও তত্বাবধান কমিটির কোন সদস্য অনুদান কমিটির সদস্য হতে পারবেনা। একই ব্যক্তি উভয় কমিটিতে থাকলে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি হবে।

উপরোক্ত সাংঘর্ষিক বিষয়গুলি সংস্কার করে চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা ২০২৫ করতে হবে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ নথিভুক্ত, যা ৫ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে, উক্ত প্রজ্ঞাপনের এই নীতিমালা কে করেছে, কার স্বার্থে করেছে? এই নীতিমালা চলচ্চিত্রের উন্নয়নের নীতিমালা হতে পারেনা। জুলাই বিপ্লবের চেতনাযর বিরুদ্ধে এই নীতিমালা হতে পারেনা। একটা বিশেষ মহল যারা বিগত ১৬ বছর লুটেপুটে খেয়ে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস করেছে। তাদের ই দোসরেরা এই নীতিমালা তৈরী করে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা ২০২৫ সংস্কারের নামে ভাউতাবাজি করা হয়েছে, লুটেপুটে খাওয়ার ধান্দাবাজি করা হয়েছে। আমরা এটি প্রত্যাখান করছি এবং অবিলম্বে আধুনিক যুগোপযুগী চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা তৈরী করার দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে যতক্ষণ না জুলাই বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়ন করা যাবে এবং আধুনিক যুগপোযুগী চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা তৈরী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত চলচ্চিত্র অনুদান প্রদান থেকে বিরত থাকার দাবি জানাচ্ছি।

গেজেটে তারিখ উল্লেখ্য করা হয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি, তবে খোজ নিয়ে জানা গেছে ২৬ ফেব্রুয়ারির আগেই পদত্যাগ করেছিলেন সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম,  ঐ দিন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কোন উপদেষ্টা (মন্ত্রীপরিষদ সদস্য পদমর্যাদার কেউ) পদে ছিলোনা, তবুও চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা কি ভাবে অনুমোদন হলো সেটি নিয়ে ধোয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। উক্ত নীতিমালা প্রকাশিত হয়েছে ৫ মার্চ, ২০২৫ তারিখে।

 

চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা ২০২৫ দেখতে ক্লিক করুন Film Anudan nitimala, 2025

চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা ২০২৫ দেখতে ক্লিক করুন Film Anudan nitimala 2020

চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা ২০১২ দেখতে ক্লিক করুন Anudan_Nitimala-2012(Amend)

উপরোক্ত চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা বিশ্লেষণ করে যে কেউ বলবো, অন্তবর্তীকালীন সরকার সংস্কারের নামে আসলে ভাউতামি করতেছে। জুলাই বিপ্লবে সহস্য শহীদের রক্তের উপর দাড়িয়ে আছে এই দেশ, কোন ভাবেই আমাদের সংবিধান বাহিরে যেয়ে কাজ করা উচিৎ নয়।

লেখক :
চিত্রনাটক্যার, চলচ্চিত্র পরিচালক
সদস্য, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি

Share