বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ
সপ্তর্ষি : মধ্যযুগের বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৪৯৪ সালে সিংহাসন আরোহণ করেন। তার শাসনামলকে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এ সময় বাংলা আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির সময়কাল অনুভব করেছিল। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা এবং পণ্ডিত ও কবিদের প্রতি তার সমর্থনের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি তার রাজদরবারের কবি সাহিত্যিকদের বিশেষ মর্যাদা ও উচ্চপদে নিযুক্ত করেন। সংস্কৃতি ও শিল্পকলার প্রতি গভীর উপলব্ধিসহ তিনি নিজে একজন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা শাসক ছিলেন।
তার শাসনামলে সাহিত্যের বিকাশে অবদান রাখার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তার দরবারে প্রতিভাবান কবি ও লেখকদের উপস্থিতি। কনস্টান্ট্রি নোপালের পতনের পর বহু গ্রিক মনীষী ইউরোপের নানা স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হোসেন শাহ তার রাজ্যে পরাজিত কবিদের আশ্রয় দেন। কুতবন ও যশোধর নামক দুজন হিন্দি কবির পরিচয় পাওয়া যায় । কুতবন এর গ্রন্থের নাম ‘মৃগবতী’ যা রোমান্টিক প্রণয়কাহিনী এ কাব্যের বিষয়বস্তু। এই সাহিত্যিক ব্যক্তিবর্গ, যাদের অনেকেরই পৃষ্ঠপোষকতা সুলতান নিজেই করেছিলেন এবং এই সময়কালে বাংলার সাহিত্যিক ভূ-প্রকৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সাহিত্যে সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা কেবল কবিতা ও গদ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলায় অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিলেন। যার ফলে এই বাংলায় সাহিত্য ঐতিহ্য সমৃদ্ধির মাধ্যমে একটি প্রাণবন্ত সাহিত্য সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে যা আজও বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করে চলেছে।
শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার হোসেন শাহের রাজত্বকালে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চৈতন্যদের ধর্মমত ব্যাখ্যা ও প্রসারের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে বেছে নিয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মের আশ্রয়ে একসময় সর্বভারতীয় পালি ভাষা। যে উন্নতি ও সংস্কৃতি মর্যাদা লাভ করেছিল। বাংলা ভাষা এর সময়ে উৎকণ্ঠা ও গৌরব লাভ করেছিল। এক্ষেত্রে হোসেন শাহ শ্রী চৈতন্যের ধর্ম মতো প্রচারকে বাধা মুক্ত করেছিলেন।
হোসেন শাহ হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন বলেই মনে হয় তার সময়ে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুদিত হতে থাকে। অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলায় অনুবাদের দায়িত্বও দিয়েছিলেন। এই গ্রন্থগুলোকে স্থানীয় ভাষায় উপলব্ধ করার মাধ্যমে, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ জ্ঞানকে গণতন্ত্রীকরণে সাংস্কৃতিক অন্বেষণের নতুন পথ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অনুবাদ করেন। এছাড়া ‘মনসা বিজয়’ ‘বৈষ্ণবপদ’ বিজয়গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ প্রভৃতি গ্রন্থ এ সময় রচিত হয়।
আদি কবি রচিত ‘মহাভারত’ মহাকাব্য পুরোপুরি রাজকাহিনী। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রাজ্যের উত্থানপতন পরাক্রান্ত দুটি রাজশক্তির সংগ্রাম সমরক্ষেত্র অসির ঝংকার আর বীরত্বের হুঙ্কারে মহাকাব্যের প্রতিটি পাতা মুখরিত।
মধ্যযুগের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শ্রেষ্ঠ কবি ও পণ্ডিত আলাওল। মুসলমান কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়। আলাওল আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসাবে আবির্ভূত হলেও মধ্যযুগের সমগ্র বাঙালি কবির মধ্যে ‘শিরোমণি আলাওল’রূপে শীর্ষস্থান অধিকারী। তিনি আরবি, ফার্সি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্রীয় ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দেন। তার রচনাগুলো আধ্যাত্মিকতা এবং রোমান্টিকতার এক অনন্য মিশ্রণ প্রদর্শন করে। তার মহাকাব্য, ‘পদ্মাবতী’, বাংলা সাহিত্যে একটি চিরন্তন ক্লাসিক হিসেবে রয়ে গেছে যা পাঠকদের এখনো মুগ্ধ করে।
মধ্যযুগের চতুর্দশ শতকের বাঙালি কবিদের মধ্যে অন্যতম কবি চণ্ডীদাস। তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। চৈতন্যের জন্মের আগে থেকেই চণ্ডীদাসের নামোল্লেখিত বহু গীতিপদ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চৈতন্য নিজে তার পদ আস্বাদন করতেন।
স্বর্ণযুগের আরেক প্রধান সাহিত্যিক ছিলেন পঞ্চদশ শতকের মৈথিলি কবি। মৈথিলির সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হলেন কবি বিদ্যাপতি (১৩৫০-১৪৫০), যিনি তার কবিতা লিখেছেন গণমানুষের ভাষায়, অর্থাৎ মৈথিলী ভাষায়, এমন সময়ে যখন রাজ্যের সরকারী ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং সংস্কৃতকেই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তার প্রচলিত পদাবলীর ভাষা ব্রজবুলি। কথিত আছে যে পরমপুরুষ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রতিদিন তার রচিত পদ গাইতে ভালবাসতেন। বাঙালিরা চর্যাগীতির ভাষা থেকে এই ব্রজবুলীকে অনেক সহজে বুঝতে পারেন। বিদ্যাপতিকে বাঙালি কবিদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। বিদ্যাপতিকে কোনো কোনো কবি দেহবাদী কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রখ্যাত কবি দৌলত কাজীও এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। আরাকানরাজ শ্রীসুধর্মার (থিরি-থু-ধম্ম, ১৬২২-১৬৩৮) সমরসচিব আশরফ খানের পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্দেশে দৌলত কাজী সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী কাব্য রচনা করেন। তিনি হিন্দি কবি মিঁয়া সাধনের মৈনাসৎ ও মোল্লা দাউদের চান্দাইন কাব্য অনুসরণ করেন বলে ধারণা করা হয়। কাব্যটির দুই-তৃতীয়াংশ রচনার পর কবির মৃত্যু হলে আলাওল বাকি অংশ সমাপ্ত করেন (১৬৫৯)। তার বাকপটু শ্লোক এবং গভীর দার্শনিক সঙ্গীতের জন্য পরিচিত ছিল।
এই প্রখ্যাত কবিদের পাশাপাশি, বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগে সৈয়দ সুলতানের মতো প্রতিভাবান লেখকের উত্থান ঘটেছিল। তার শ্রেষ্ঠ রচনা, নবীবংশা (১৫৮৪) এর জন্য সর্বাধিক পরিচিত, যা ছিল বাংলা ভাষায় কিসাস আল-আম্বিয়ার প্রথম অনুবাদগুলোর মধ্যে একটি। তার সাহিত্যকর্মগুলো বাংলাদেশের স্কুল স্তর, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্যের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একজন দক্ষ গল্পকার যার প্রেম এবং আবেগের গল্প সারা বাংলার দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। তার প্রাণবন্ত বর্ণনা এবং আকর্ষক আখ্যান বাঙালি সংস্কৃতির সমৃদ্ধ টেপেস্ট্রিকে জীবন্ত করে তুলেছে।
ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ এর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। লোককাহিনী এবং পৌরাণিক কাহিনীর এক মনোমুগ্ধকর রচনা যা আজও পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
রায়গুণকার ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২-১৭৬০) : অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি। হাওড়া জেলার পেড়ো-বসন্তপুরে জন্ম। পরবর্তী জীবনে তিনি নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় অন্নদামঙ্গল কাব্যের স্বীকৃতিতে তাকে ‘রায়গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।