স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী শক্তি থেকে মূলধারার রাজনীতিতে জামায়াত ইসলামী
সপ্তর্ষি: জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল, যার উত্থান ও বিকাশের প্রক্রিয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠনের পর থেকেই বিতর্কিত। এই দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। তবুও, স্বাধীনতার পরেও তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই প্রতিবেদনটিতে দলটির উত্থান, রাজনৈতিক কৌশল, এবং তাদের অবস্থান ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠাকাল ও স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা: জামায়াতে ইসলামী প্রথমত প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪১ সালে, উপমহাদেশের বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনের অংশ হিসেবে। তবে, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছিল, জামায়াত ইসলামী তখন পাকিস্তানের সমর্থনে একাধিক সহায়ক বাহিনী গঠন করে। তাদের ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্র সংঘ থেকে গঠিত হয় “আল-বদর” ও “আল-শামস” বাহিনী, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও বুদ্ধিজীবীদের নিধনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তাদের এই ভূমিকার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামীকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে দেখা হয়।
স্বাধীনতার পর রাজনীতিতে ফিরে আসা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয় এবং দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক শাসনের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই সময়ে, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতে ইসলামী পুনরায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে।
রাজনৈতিক মিত্র ও জোটের মাধ্যমে শক্তি অর্জন: ১৯৮০-র দশকে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের আমলে, জামায়াত ইসলামী আবারও রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ শুরু করে এবং এরশাদের বিরোধী জোটে অংশ নেয়। পরবর্তীতে, ১৯৯১ সালে যখন বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক শক্তি পুনর্গঠনের মাধ্যমে সংসদে আসন লাভ করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে, বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) এর সাথে মিত্রতা গড়ে তোলার মাধ্যমে দলটি তাদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করে।
রাজনীতিতে আদর্শিক পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক কৌশল: জামায়াতে ইসলামী নিজেদের মূল আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করলেও, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারা নিজেদের কৌশলগত পরিবর্তন আনে। ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে দলটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জোট রাজনীতির মাধ্যমে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যায়। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে, এবং জামায়াতের দু’জন নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পান। এটি ছিল তাদের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় অর্জন।
যুদ্ধাপরাধ ও বর্তমান সংকট: স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত হন, যার ফলে তাদের অনেকে মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়। এর পর থেকেই দলটির রাজনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসে এবং জনসমর্থন কমতে থাকে।
জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ফলে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের অভাব এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তার সংকট দলের ভবিষ্যতকে আরও অনিশ্চিত করেছে। তাছাড়া, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিতি দলের সমর্থন বেসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন না আনলে ভবিষ্যতে দলটি আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী, যারা একসময় স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতা করেছিল, তাদের উত্থান ও বিকাশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রাজনৈতিক কৌশল, জোট রাজনীতি, এবং আদর্শিক পরিবর্তনের মাধ্যমে দলটি দীর্ঘদিন ক্ষমতার অংশীদার হতে পেরেছে। তবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দলটি যদি ভবিষ্যতে টিকে থাকতে চায়, তবে তাদেরকে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নিজস্ব কৌশলগত ও আদর্শিক পরিবর্তন আনতে হবে।