চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্যের বিরুদ্ধে অভিনেত্রীকে হয়রানির অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ চলচ্চিত্র লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হোসেনকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য করার পরে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তুমুল সমালোচনার মধ্যেই জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ তুললেন নবাগত চিত্রনায়িকা শর্মিলা তুলি।

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর, সন্ধ্যায় শর্মিলা তুলি তার ফেসবুক আইডিতে একটি পোষ্ট দিয়েছেন, সেখানে অভিযুক্ত জাহিদ হোসেনকে নিচু চরিত্রের, বাটপার চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অভিযোগ করেছেন এই নবাগত চিত্রনায়িকা, একই চরিত্রে দুইজন অভিনেত্রীকে কাস্টিং করে অসৎ ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী। অভিনেত্রীকে পারিশ্রমিক না দিয়ে ঘুরিয়েছেন সেই অভিযোগও করেন তিনি।

ছবি : নবাগত চিত্রনায়িকা শর্মিলা তুলির শুটিং চিত্র

শর্মিলা তুলির পোষ্ট টি হুবহু তুলে ধরা হলো-

একজন বাটপার পরিচালক জাহিদ হোসাইনকে নিয়ে কিছু কথা, দেখতে ভালো মনে হলেও, উনার স্বভাব চরিত্র খুব নিচু। আর একজন পরিচালকের মন-মানসিকতা যদি এমন হয়। তাহলে ভালো সিনেমা বানানো কখনো সম্ভব না। আজ থেকে চার মাস আগে আমাকে ঋতু-কামিনী নামে একটি সিনেমার গল্প শোনায়। গল্প শোনার পর আমার ভালো লাগে আমি সিনেমাটি করতে রাজি হই। তারপর কিছুদিন আগে সিনেমার শুটিংয়ে যাওয়া হয়, চারদিন আমি শুটিংও করি। জাহিদ হোসাইন যেটা করলো সেম আমাকে যেই গল্পটা শোনালো। সেই গল্পটা আরো একটি মেয়েকেও শুনিয়ে শুটিংয়ে নিয়ে যায়। তারপর এটা নিয়ে সেটে অনেক ঝামেলা হয়। ওই মেয়ের ভয়ের কারণে আমার সিনগুলো পরিচালক সাহেব আজ কাল করবে বলে আর করা হয় না। আমার কথা হল একটা পরিচালকের মন মানসিকতা এত নোংরা স্বভাবে হবে কেন। একটা ক্যারেক্টার এর জন্য দুজনকে বলে নিয়ে যাওয়ার কি দরকার। বাটপার চিটার ছাড়া এমন কাজ কেউ করে না। এবং আমার পরিশ্রমের টাকাটা এখনো আমি পাইনি। আজকাল দিবে বলে এখন আর আমার ফোনও করছে না। ওনাদের মতো লোক দের কারণে আজ আমাদের ইন্ডাস্ট্রির এই অবস্থা।কিছুদিন আগে দেখলাম অনেকেই ওনার স্বভাব চরিত্র নিয়ে বাজে পোস্ট করেছে এই ধরনের লোক কখনোই লিডার বা সম্মানিত লোক হতে পারে না।

এই পোষ্টের নিচে বিশাল ফরহাদ নামের একজন পরিচালক মন্তব্য করেছেন “একজন ধর্ষকের কাছে এর চাইতে ভালো কিছু আশা করা যায় না, প্রতিবাদ করো, তোমার পাশে আমরা আম জনতা আছি।”

চলচ্চিত্র পরিচালক আব্দুস  সামাদ খোকন মন্তব্য করেছেন “ছিঃ!কি লজ্জার কথা। বিষ্মিত হলাম।তাকে অনেক পছন্দ করতাম।ছোট ভাই হিসেবে ভালোও বাসতাম। চলচ্চিত্র পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সম্মানিত কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য ভাইদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিষয় টি নিষ্পত্তি করতে অনুরোধ করছি।”

মুস্তাফিজুর রহামন খোকন মন্তব্য করেছেন “এই লোক কখনোই সুবিধার লোক ছিলোনা। বরাবরাই আওয়ামী লীগের দালাল ছিলো।”

আরজে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিবুল হক রনি মন্তব্য করেছেন “বিচারের আওতায় আনা উচিত। আমরা আপনার সাথে আছি।”

উল্লেখ্য, “আমার স্বপ্ন তুমি”, “কপাল”, “জন্ম”, “তুমি আছো হৃদয়ে”, খ্যাত প্রয়াত গুণী চলচ্চিত্র পরিচালক হাসিবুল ইসলাম মিজানের কন্যা নবাগত চিত্রনায়িকা শর্মিলা তুলি অভিনীত বেলাল সানি পরিচালিত “মার্ডার” সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায়, আরো বেশ কয়টি সিনেমাতে তিনি অভিনয় করছেন বলে জানান।

গুনী চলচ্চিত্র পরিচালকের কন্যা এই নবাগত চিত্রনায়িকা অভিযোগ করে জানান, জাহিদ আংকেল আমার বাবার বয়সি, কিন্তু তার আসল চেহারা জানতে হলে ঋতু-কামীনি সিনেমার শুটিং সেটের অনাকাঙ্খিত ঘটনা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি কেনো একই চরিত্রে দুটি মেয়েকে নিয়েছে সেটি আপনারা আশা করছি বুঝতে পারছেন। আমি একজন পরিচালকের অপকর্ম মুখে আনতে চাইনা।

নবাগত এই চিত্রনায়িকা আরো জানান, জাহিদ হোসেন উচ্চ মহলে বিশেষ কায়দায় সুবিধা গ্রহণ করেন, সেটি কারু জানার বাকি নেই। আমি সুষ্ঠ তদ্বন্তের মাধ্যমে এই ঠকবাজ পরিচালকের বিচার চাই। আমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি আমার পাশে দাড়াতেন। আমার বাবা বেঁচে না থাকলেও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্যরা আছেন, আমি লিখিত অভিযোগ করে জাহিদ হোসেনের বিচার চাইবো।

অভিযুক্ত জাহিদ হোসেন প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুক একটি পোষ্ট কেরছেন। সেটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

অ‌ভিনয় সহ‌শিল্পীর অ‌ভি‌যো‌গের প‌রি‌প্রে‌ক্ষি‌‌তে বল‌ছি ।।
আমার পর‌িচা‌লিত চলচ্চ‌িত্র ঋতুকা‌মিনী পোস্ট প্রডাকশনের কাজ চল‌ছে। ছ‌বির সু‌টিং কাজ এখনও বা‌কি আ‌ছে। একজন সহ‌শিল্পী আমার বিরু‌দ্ধ‌ে যে অ‌ভি‌যোগ ক‌রে‌ছে তা সত‌্য নয়। তা‌কে কিছু টাকা প্র‌যোজক আমার মাধ‌্যমে দিয়ে‌ছে। পরবর্তী সু‌টিং এর আ‌গে আবার দেয়া হ‌বে। ই‌তিম‌ধ্যে আজ কারও প্র‌রোচনায় আমা‌কে খা‌টো করার জন‌্য স‌ে সামা‌জিক মাধ‌্যমে আমার বিরু‌দ্ধে মনগড়া কথা লি‌খে‌ছে। তা আমা‌দের চলচ্চ‌িত্র শি‌ল্পের সকল চল‌চ্চিত্র প‌রিচালক‌দেরই অপমা‌নিত ক‌রে‌ছে। চল‌চ্চিত্র শি‌ল্পে শিল্পী কলাকু‌শিলীদের দেনা পাওনা থা‌কে। চল‌চ্চিত্র শেষ করার আ‌গে‌ই প্র‌যোজক তা পর‌ি‌শোধ ক‌রে দেয়ার চেষ্টা ক‌রেন। সে কোন পেশাদারী অ‌ভিনয় শিল্পীও নয়। আমার প্রয়াত বন্ধু চল‌চ্চিত্র প‌রিচালক মিজানুর রহমান মিজান ভাই তা‌কে মে‌য়ে সমতুল‌্য শ্নেহ কর‌তেন। আ‌মি তা‌কে সেই সূ‌ত্রেই চল‌চ্চি‌ত্রে সহ‌যোগ‌িতা কর‌ে‌ছি। তা‌র অ‌ভিনয় জীব‌নের জন‌্য মঙ্গল কামনা ক‌রছি।
জাহিদ হোসেনের পোষ্টের নিচে মন্তব্য করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া (সায়মন তারিক) ।
উল্লেখ্য, জাহিদ হোসেনের পোষ্টে মিথ্যাচার স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, একজন গুণী চলচ্চিত্র পরিচালকের মেয়ে, যিনি জন্মের পর থেকে ই সিনেমার পরিবেশে বড় হয়েছে, সম্প্রতি ক্যারিয়ার শুরু করেছেন, তাকে নিয়ে অপমানজনক “কোন পেশাদার অভিনয় শিল্পী নয়” কথা  বলায় জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে চলচ্চিত্রের অনেক গুণী নির্মাতা ও শিল্পীরা। চলচ্চিত্র পরিবারের একজন মেয়েকে নিয়ে এমন বিরুপ মন্তব্য করায়, মূলত পুরো চলচ্চিত্র সমাজকে হেয় করেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের সুবিধা নিয়ে অত্যান্ত দপাটে চলতো সে। বুয়েটের আবরার হত্যা বিচারের বিরুদ্ধে সেই সময় একাধিক পোষ্ট দিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময় তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধী জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে কুৎসামূলক মন্তব্য করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধা নিতেন। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, তারেক রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন সময় নেতিবাচক লেখালেখি করে আওয়ামী লীগ সরকারের চলচ্চিত্র অনুদান সহ অনেক অর্থ সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। জামায়াতের রাজনীতি করার অধিকার নিয়ে অযৌক্তি লেখালেখি করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আস্তাভাজন হয়ে ছিলেন তিনি।
ছবি : জাহিদ হোসেনের ফেসবুক পোষ্টের স্ক্রীনশর্ট

গত ২২ সেপ্টেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে  ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’-এর ৩ ধারার উপধারা (১) অনুযায়ী ১৫ সদস্যের সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়েছে। সেখানে সদস্য করা হয়েছে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হোসেনকে। প্রজ্ঞাপনজারির পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়। বিভিন্ন গুনী নির্মাতারা কমিটি পুর্নুগঠনের দাবি জানিয়ে ফেসবুক পোষ্টে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

সিনেমাকিং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক মনজুরুল ইসলাম মেঘ এক ফেসবুক পোষ্টে জানিয়েছেন, বুয়েটের আবরার হত্যার বিরোধীতাকারীকে জাহিদ হোসেনকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য করার প্রতিবাদে এবং খুনি আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী একাধিক ব্যক্তিদের এই কমিটির সদস্য করার প্রতিবাদে আমার কোন সিনেমা সার্টিফিকেশনের জন্য বোর্ডে জমা দিবোনা, প্রয়োজনে ইউটিউবে মুক্তি দিবো তবু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি হতে দিবোনা।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাবেক সভাপতি বদিউল আলম খোকন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র লীগের এই নেতা আগে থেকে বাটপারী ও সুবিধাবাদী ছিলো, ফ্যাসিস্ট সরকারের দালাল হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতোনা । বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এই আওয়ামী দোসর সর্বক্ষণ চেয়েছে ছাত্রজনতা পরাজিত হোক আর স্বৈরাচারী হাসিনা জয়ী হোক, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের চিহ্নিত একজন দালাল কি করে নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পদে জায়গা পায়, সেই প্রশ্ন জনতার কাছে।

ছবি : বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য জাহিদ হোসেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের একাধিক সদস্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো এবং আওয়ামী সরকারের তোষামোদী করে চলচ্চিত্র অনুদান গ্রহণ করেছে, তারাই আবার এই সরকারে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কমিটিতে জায়গা দখল করেছে।

Share