ক্রিকেটার থেকে ব্যবসায়ী: সাকিবের পুঁজিবাজার যাত্রার বিতর্কিত অধ্যায়

সপ্তর্ষি: সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, মাঠে তার অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে খেলার বাইরেও তিনি নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন, যা তাকে প্রায়শই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে, পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজির দায়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে। এটি তার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সর্বশেষ বিতর্ক, যা দেশের ক্রীড়া মহলে নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে।

২০১৭ সালে সাকিব আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের পুঁজিবাজারে প্রবেশ করেন এবং বিএসইসির শুভেচ্ছাদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ক্রিকেটার হিসেবে তার বিনিয়োগ করার কোনও আইনি বাধা না থাকলেও তার পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ততা নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। বিশেষ করে, দেশের পুঁজিবাজারের আলোচিত বিনিয়োগকারী মো. আবুল খায়ের হিরুর মাধ্যমে বিনিয়োগ এবং কিছু শেয়ার কারসাজির অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর একাধিক তদন্তে তার বিরুদ্ধে সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে, যদিও সেই সময়ের বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিগত কয়েক বছরে সাকিবের শেয়ার কারসাজি সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও সেগুলোর উপযুক্ত তদন্ত হয়নি। তবে ২০২৩ সালের আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএসইসির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে, এবং নতুন চেয়ারম্যান আগের অনিয়মগুলো তদন্তের উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় সাকিবকে শুভেচ্ছাদূতের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং পুঁজিবাজারের শেয়ার কারসাজির জন্য ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। শুধু সাকিবই নয়, তার সঙ্গে যুক্ত আরও কয়েকজন বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করা হয়।

পুঁজিবাজারের সঙ্গে সাকিবের বিতর্কিত সম্পৃক্ততা তার সামগ্রিক ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দেশের ক্রীড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, সাকিব একজন আদর্শ ক্রিকেটার হিসেবে মাঠে যেমন উদাহরণ স্থাপন করেছেন, তেমনি মাঠের বাইরের নানা আর্থিক কারসাজির কারণে তিনি তরুণ ক্রিকেটারদের ভুল পথে চালিত করছেন। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং এতে ক্রীড়া জগতের নৈতিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শেয়ার কারসাজি ছাড়াও, বেটউইনার নিউজ নামক একটি বেটিং সাইটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং পুলিশের হত্যার আসামি আরাভ খানের জুয়েলারি শোরুম উদ্বোধন করার ঘটনা তাকে আরও বিতর্কের মধ্যে ফেলে।

২০২২ সালে সাকিব আল হাসান বেটউইনার নিউজের বিজ্ঞাপনে চুক্তিবদ্ধ হন, যা সে সময় তার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করে। বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড)-এর অনুমতি ছাড়া কোনো ক্রিকেটার পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে পারবে না, এমন নিয়ম থাকা সত্ত্বেও সাকিব এ চুক্তি বাতিল করতে চাননি। তবে বিসিবির চাপে তিনি শেষমেশ সেই চুক্তি থেকে সরে আসেন। এরপরে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে আসে যে বেটউইনারের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করা হচ্ছিল, যা সাকিবের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। এ কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে নিজেদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সাকিবের ব্যবসায়িক কার্যক্রমও অনেক সময় তাকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। ২০২৩ সালে তিনি পুলিশ হত্যার আসামি আরাভ খানের জুয়েলারি শোরুম উদ্বোধনে যোগ দেন, যা দেশে ও বিদেশে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে। এর আগে, ২০১৯ সালে আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) সাকিবকে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করার কারণে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল। এসব বিতর্কের পরও সাকিব নিজেকে আর্থিকভাবে আরও প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিগত বছরগুলোতে সাকিব বিভিন্ন খাতে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ করেছেন। রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শপিং মল, ট্রাভেল এজেন্সি, প্রসাধনীসহ নানা ক্ষেত্রে তার বিনিয়োগ রয়েছে। তিনি শুধু দেশেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশেও ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ করেছেন। তবে মাঠে যেমন তার সাফল্য, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তেমন সফলতা পাননি। তার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়ে, এবং কিছু প্রতিষ্ঠান তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন।

সব মিলিয়ে, সাকিব আল হাসান শুধু মাঠের খেলায় নয়, ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জড়িয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। এসব ঘটনা তার ক্রীড়াজীবন এবং ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করছে।

Share