Thursday, November 7, 2024
ডাটাশিক্ষা

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন: স্বাধীন চিন্তা ও বিশ্বমানবতার দীক্ষা

সপ্তর্ষি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনা ছিল মূলত মানবিক, সৃজনশীলতা ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলার উপর ভিত্তি করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা কেবলমাত্র পুঁথিগত জ্ঞান নয়, বরং মানুষের চিন্তা-চেতনা ও সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে। তাঁর শিক্ষাদর্শন ভারতীয় সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে এবং তিনি শিক্ষার মাধ্যমে একটি মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর শিক্ষাভাবনার অন্যতম প্রতিফলন।

প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ: রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ রেখে শিক্ষাগ্রহণ করলে শিশুরা মুক্তভাবে বিকশিত হতে পারবে। তিনি প্রথাগত ক্লাসরুমের বাঁধাধরা পরিবেশের পরিবর্তে খোলা আকাশের নিচে, প্রকৃতির মধ্যে বসে শিক্ষা গ্রহণের উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির মধ্যে থেকেই শিশুদের চিন্তার স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতা উদ্ভাসিত হয়। এই কারণেই শান্তিনিকেতনের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা।

স্বাধীন চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশ: রবীন্দ্রনাথের মতে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো শিশুর স্বাভাবিক প্রতিভার বিকাশ ঘটানো এবং স্বাধীন চিন্তা করতে শেখানো। তিনি প্রথাগত পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমালোচনা করতেন, কারণ তা শিশুদের সৃজনশীলতা ও কৌতূহলকে সীমাবদ্ধ করে। তিনি মনে করতেন যে শিক্ষা যেন শিশুদের জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে এবং তাদের মনের দুয়ার খুলে দেয়। তাই তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় গান, নৃত্য, চিত্রকলা, নাটক ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দেন।

আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্বমানবতার চেতনা: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আন্তর্জাতিকতাবাদ। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে একটি বিশ্বজনীন চেতনা গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন, যেখানে জাতি, ধর্ম বা ভাষার কোনো বিভাজন থাকবে না। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার এক অনন্য উদাহরণ। এখানে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন।

মানবিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব: রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক, দায়িত্বশীল ও উদারমনস্ক হতে হবে। তাঁর মতে, শিক্ষা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং নৈতিক চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি, শ্রদ্ধা এবং পরোপকারিতার মতো গুণাবলী গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছিলেন।

শিক্ষার স্বাধীনতা ও শৈল্পিক বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার কঠোর নিয়ম-কানুন থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, শিক্ষা এমন হওয়া উচিত যা শিক্ষার্থীর মনের বিকাশ ঘটায় এবং তার সৃজনশীলতা এবং নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের সুযোগ দেয়। শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে ভাবতে ও কাজ করতে উৎসাহিত করা হতো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর শিক্ষাদর্শন শুধুমাত্র বইভিত্তিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে শিশুর সৃজনশীলতা, মানবিক মূল্যবোধ, এবং প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনকে গুরুত্ব দেয়। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি আজও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষাবিদদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফেসবুক সংবাদ

Moralook Limited